উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে সারাদেশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ মোতায়েন
ভোটের বাকি ১ দিন, অপেক্ষায় বাংলাদেশ
৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮, রোববার। বাংলাদেশের ইতিহাসের বেশিরভাগ দিন থেকে একদম আলাদা। যেন এক জাজমেন্ট ডে। রায়ের দিন। গণতন্ত্রে জনগণ তো আসলে একদিনের বাদশাই।
ধনী-গরিব-রাজা-প্রজা সবারই এক ভোট। কী অদ্ভুত সাম্য! অনেকদিন ধরেই ভোট এখানে রীতিমতো উৎসব। তবে এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। প্রচারণার রক্তাক্ত অধ্যায় শেষ হয়েছে । এখন চারদিকে নীরবতা, নিস্তব্ধতা। ঢাকা এরই মধ্যে ফাঁকা। মানুষ ছুটছেন গ্রামে। যেন ঈদের ছুটি। তারা যোগ দিতে চান উৎসবে।
একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই নানা আলোচনা ছিলো। বছরের সবচেয়ে আলোচিত শব্দটি ছিল সম্ভবত ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’। অনেকটা নাটকীয়ভাবেই মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে ড. কামাল হোসেনের। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি পুরনো চরিত্র। তারপরও বিএনপির সঙ্গে তার জোট বাধা কম বিস্ময়ের তৈরি করেনি। খালেদা জিয়ার সাজা, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ। দৃশ্যত কোনো দাবি মেনে না নেয়ার পরও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়। প্রচারণায় বাধা, হামলা, রক্তাক্ত প্রার্থী। সংশয় ছিলো শেষ পর্যন্ত বিরোধীজোট নির্বাচনে থাকে কি-না? কিন্তু তারা এখনো বলছেন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা নির্বাচনে থাকবেন।
এমনিতে ইতিহাসের এক ব্যতিক্রম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলছে। সরকার বহাল। সংসদ বহাল। সব দলের অংশগ্রহণ। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে কিছুদিন অনেক কথা হয়েছে। এখন আর সে কথা কেউ মুখে তুলছেন না। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ একেবারেই সীমিত। একতরফা প্রচারণা। বিরোধীরা মাঠ ছাড়া। কী হবে আগামীকাল। বাংলাদেশের মতো সারা দুনিয়াতেও এ নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পর এখন বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ধরনের নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করেছেন।
আগেই বলা হয়েছে, ভোট এখানে উৎসব। সকাল সকাল দীর্ঘ লাইন। অনেক পশ্চিমা দেশেও এমনটা দেখা যায় না। তবে কেন্দ্র দখল, গায়েবি ভোটের নজিরও এখানে আছে। ভালো, মন্দ। কালো, সাদা। আমাদের রেকর্ডে সবই আছে। কাল কী হবে? ভোটাররা কী একদিনের বাদশাহী ফিরে পাবেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কৌতুক দেখা যাচ্ছে। নিরাপদে ভোট দিয়ে ফেরার জন্য দোয়া চেয়ে ফেসবুকে অনেকে পোস্টারও আপলোড করছেন। জীবিত, প্রাপ্তবয়স্করা যেন একটি করে ভোট দিয়ে নিরাপদে, নির্ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন, বাকি জীবনটাও শান্তিতে কাটাতে পারেন এমন ভোটই চায় সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতান্ত্রিক জনতা।
রোববার সকাল ৮টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ২৯৯ আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এবার নির্বাচনে ১৮৬১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে নিবন্ধিত ৩৯ দলের ১৭৩৩ জন ও স্বতন্ত্র ১৮২ জন রয়েছে। ভোটগ্রহণ কার্যক্রমকে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছে। আসনওয়ারি সর্বশেষ সামগ্রী ব্যালট পেপার পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এর আগেই ভোটের অন্যান্য সরঞ্জামাদি মনোহরী দ্রব্য যেমন, অমোচনীয় কালির কলম, সিলগালা, মার্কিং ও ব্রাসসিল আসনওয়ারি পৌঁছে দেয় ইসি। আজ শনিবার ভোটের সমাগ্রী সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পুলিশ পাহারায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে নিয়ে যাবেন কেন্দ্রের মনোনীত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা।
নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ শুক্রবার বিকালে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে ভোটের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন, ভোট নিয়ে কোন শঙ্কা নেই। আশা করছি, নির্বিঘ্নে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। তিনি বলেন, সরকারিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ১৫ লাখ লোক এ ভোট পর্যবেক্ষণ করছে।
ভোটগ্রহণ উপলক্ষে রোববার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। ব্যাংকও বন্ধ রাখা হয়েছে ২৮ থেকে ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ হয়েছে শুক্রবার বিকাল ৫টা থেকে, এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে ৩০শে ডিসেম্বর বিকাল ৫টা পর্যন্ত। নির্বাচনে কালো টাকার দৌরাত্ম্য বন্ধে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এ উপলক্ষে জনগণের ভোগান্তি কমাতে এটিএম বুথগুলোতে পর্যাপ্ত টাকা রাখার নির্দেশনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যানবাহন চলাচলের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। কমিশনের অনুমোদিত পরিচয়পত্রধারীর বাইরে কোন যান-চলাচল করবে না।
এবারের নির্বাচনটি গত দশম জাতীয় সংসদের থেকে একটু আলাদা আমেজ বিরাজ করছে। কারণ নিবন্ধিত সব দল এবারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এর পাশাপাশি অনিবন্ধিত অনেক রাজনৈতিক দল প্রধান দুই জোটের জোটবদ্ধ সঙ্গী হয়ে এ নির্বাচনে লড়ছেন। এর বাইরে বাম মোর্চা ও ইসলামী কয়েকটি দলের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মাঠে চষে বেড়িয়েছেন।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরের সাধারণ কেন্দ্রে ১৪ থেকে ১৫ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৬ জন সদস্য মোতায়েন থাকবেন। মেট্রোপলিটন এলাকার কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ওই সংখ্যা থেকে ১ জন করে বেশি রাখা হবে। পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল, হাওড় এলাকার কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা আরও বেশি থাকবে। এবার নির্বাচনে আচরণবিধি প্রতিপালনে মাঠ পর্যায়ে ১ হাজার ২০০ জন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। তবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র্যাব ও পুলিশের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং টিমের সঙ্গে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট দেয়ার জন্য অতিরিক্ত ১ হাজার ৯৩৭ জনের চাহিদা দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল ইসি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬৭৬ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়েছে মন্ত্রণালয়। শুধু ভোটকেন্দ্র পাহারায় পুলিশসহ ৬ লাখ ৮ হাজার জন সদস্য দায়িত্ব পালন করছে।
এর মধ্যে পুলিশ ১ লাখ ২১ হাজার, আনসার ৪ লাখ ৪৬ হাজার ও গ্রামপুলিশ ৪১ হাজার। এছাড়া ৪১৪ প্লাটুন সেনাবাহিনী, ৪৮ প্লাটুন নৌ-বাহিনী, কোস্টাগার্ড ৪২ প্লাটুন, বিজিবি ৯৮৩ প্লাটুন ও র্যাব ৬০০ প্লাটুন। এছাড়া স্টাইকিং ও রিজার্ভ র্ফোস হিসেবে ২ হাজার প্লাটুন র্যাব ও বিজিবিসহ ৬৬ হাজার সদস্য নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করছে। সব সংসদীয় আসনের নির্বাচন শেষ করতে ৬৬ জন রিটানিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৪ জেলায় সমসংখ্যক এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুই বিভাগীয় কমিশনার এ দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সহায়তা করতে ৫৮২ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছে এ নির্বাচনে। নির্বাচনে শুধু ভোটারদের ভোটদানে সহায়তা করার জন্য ৬ লাখ ৬২ হাজার ১১৯ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন।
এর মধ্যে প্রিজাইডিং অফিসার ৪০১৮৩ জন, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২ জন এবং পোলিং অফিসার ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন। প্রথমবারের মতো এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ করা হবে। আসনগুলো হচ্ছে-ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ এবং সাতক্ষীরা-২ আসন। এসব আসনের ৮৪৫টি কেন্দ্রের ৫ হাজার ৩৮ ভোটকক্ষে এ মেশিন ব্যবহার করা হবে। এ ছয়টি আসনে ভোটার সংখ্যা ২১ লাখ ২২ হাজার। এবার ১ কোটি ২৩ লাখ নতুন ভোটার। নতুন ভোটারসহ মোট ভোটার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন। তবে, মহিলাদের চেয়ে পুরুষ ভোটার বেশি; যার মধ্যে ভোটের ব্যবধান প্রায় ৯ লাখ। এবার পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫ জন এবং মহিলা ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২ জন।
নির্বাচনে ৮১টি নিবন্ধিত পর্যবেক্ষক সংস্থার ২৫ হাজার ৯শ জন ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন। এছাড়া বিদেশিদের মধ্যে ফেমবোসা, ওআইসি, কমনওয়েলথস ও অন্যান্য সংস্থার ৩৮ জন, কুটনীতিক ও বিদেশি মিশনের ৬৪ কর্মকর্তা এবং ঢাকাস্থ দূতাবাস/হাইকমিশন বা বিদেশি সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন ভোট পর্যবেক্ষক করবেন।
উল্লেখ্য, গত ৮ই নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবির মুখে গত ১২ই নভেম্বর পুনঃতফসিল ঘোষণা করে ৩০শে ডিসেম্বর ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে গাইবান্ধা-৩ আসনে ভোট স্থগিত করে ২৭ জানুয়ারি পুনঃভোট দেয়া হয়েছে।
এলএবাংলাটাইমস/এন/এলআরটি
শেয়ার করুন