খুলনায় রাকিব হত্যা মামলায় দুজনের মৃত্যুদণ্ড
খুলনায় শিশু রাকিব হাওলাদার হত্যা
মামলায় তিন আসামির মধ্যে দুজনকে
মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে খালাস দিয়েছেন
আদালত। গতকাল রবিবার আসামিদের
উপস্থিতিতে খুলনার দায়রা জজ
(ভারপ্রাপ্ত) দিলরুবা সুলতানা
বর্বরোচিতভাবে শিশু খুনের এ মামলার রায়
দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো মামলার প্রধান
আসামি শরীফ মোটরসের মালিক ওমর শরীফ
ও তার সহযোগী চাচা মিন্টু খান। আদালত
শরীফের মা বিউটি বেগমকে বেকসুর
খালাসের আদেশ দেন।
আদালত রায়ে কম্প্রেসার মেশিনের হাওয়া
দিয়ে হত্যার ঘটনাকে 'পৃথিবীতে বিরল
ঘটনা' বলে মন্তব্য করেছেন। মাত্র ১১ কার্য
দিবসে আলোচিত এ হত্যা মামলার রায়
প্রদানের মাধ্যমে আদালত এক ঐতিহাসিক
নজির সৃষ্টি করেছে।
রায় ঘোষণার পর রাকিবের স্বজনরা বিউটি
বেগমের খালাস প্রাপ্তিতে ক্ষোভ প্রকাশ
করেছে। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে
তারা আদালত চত্বরে ও সামনের সড়কে
বিক্ষোভ করে।
সেদিনের ঘটনা : অন্য গ্যারেজে কাজ
নেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে গত ৩ আগস্ট সন্ধ্যায়
শরীফ মোটরস গ্যারেজের মালিক ওমর শরীফ
ও তার সহযোগী মিন্টু দোকানের ভেতরে
নিয়ে শিশু রাকিবের মলদ্বারে
মোটরসাইকেলের চাকায় হাওয়া দেওয়ার
মেশিন দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে দেয়। এতে
রাকিবের শরীর ফুলে যায় এবং ভেতরের
নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যায়। ভেতরে রক্তক্ষরণের
কারণে রাকিব মারা যায়। এ ঘটনায়
রাকিবের বাবা আলম হাওলাদার তিনজনকে
আসামি করে পরদিন খুলনা সদর থানায়
মামলা করেন। রাকিবের মৃত্যুর খবর পেয়ে
ওই দিন রাতে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতালে বিক্ষুব্ধ জনতা শরীফ ও
মিন্টুকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ
করে। পুলিশ পরে শরীফের মাকেও গ্রেপ্তার
করে। গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনই হত্যায়
প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে আদালতে ১৬৪
ধারায় জবানবন্দি দেয়।
বিচারপ্রক্রিয়া : গত ২৫ আগস্ট আলোচিত এ
হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও খুলনা সদর
থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী
মোস্তাক আহম্মেদ মুখ্য মহানগর হাকিম
মেজবাহ উদ্দিন আহমদের আদালতে
অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ৬ সেপ্টেম্বর
অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত মামলাটি
মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠিয়ে দেন।
২২ সেপ্টেম্বর মহানগর দায়রা জজ
আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক (অতিরিক্ত
মহানগর দায়রা জজ) দিলরুবা সুলতানা
মামলার নির্ধারিত দিনে অভিযোগপত্রটি
আমলে নেন।
গতকাল আদালত তাঁর মন্তব্যে বলেন,
'আসামিরা ভিকটিম রাকিবের শরীরের
সেনসেটিভ অংশে মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার
করিয়াছে তাহাতে গিলটি ইনটেশন ছিল,
তাহা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
আসামিরা যেভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে,
যে অস্ত্র দিয়া মৃত্যু ঘটানো হয়েছে, তা
বিরল ঘটনা। আসামিরা অভিনব কৌশলে
কম্প্রেসার মেশিনের মতো একটি যন্ত্র
দ্বারা মৃত্যু ঘটাইয়াছে, যাহাতে বর্বরতা
এবং নিষ্ঠুরতার বিষয়টি বিচারের ক্ষেত্রে
সাংঘাতিকভাবে সামনে এসে
দাঁড়াইয়াছে।'
রায়ের প্রতিক্রিয়া : আদালতের পিপি
সুলতানা রহমান শিল্পী মাত্র ১১ দিনে
আলোচিত মামলার রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ
করে বলেন, রায়ে বাদীপক্ষ ন্যায়বিচার
পেয়েছেন; তার পরও এক আসামি খালাস
পেয়েছেন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি দেখে এ
বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মোমিনুল ইসলামও
একই মন্তব্য করেন। আসামিপক্ষের
আইনজীবী তৌহিদুর রহমান চৌধুরী তুষার
রায়কে আবেগতাড়িত উল্লেখ করে বলেন,
'আমরা উচ্চ আদালতে যাব। একই সঙ্গে
আসামিরা জেল আপিলও করবেন।'
খুলনায় বহুল আলোচিত শিশু রাকিব হত্যা
মামলার রায়কে কেন্দ্র করে গতকাল
রবিবার গোটা আদালত এলাকা ছিল
হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে সরব।
রাকিবের মা লাকী বেগম, বাবা আলম
হাওলাদার ও বোন রিমি খাতুন স্বজনদের
সঙ্গে সকালেই আদালতে পৌঁছান। তাঁদের
পাশে ছিল এলাকাবাসী। সাংবাদিক,
আইনজীবী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর সদস্যদের পদভারে মুখরিত গোটা
আদালত।
রায় শোনার পরপরই রাকিবের মা লাকী
বেগম জ্ঞান হারান। বোন রিমি খাতুন
আসামি বিউটি বেগমের খালাসের খবর শুনে
চিৎকার শুরু করে। 'ওর ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই;
আমার ভাইয়ারে ওরা মাইরা ফালাইছে।
ওগো কোনো ক্ষমা নাই।' রাকিবের বাবা
আলম হাওলাদারও বিউটি বেগমের খালাসে
ক্ষোভ জানান। পরে আসামীদের কারাগারে
নিয়ে যাওয়ার সময় রাকিবের প্রতিবেশীরা
বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এক পর্যায়ে
আসামীদের বহনকারী প্রিজন ভ্যানে
ইটপাটকেল ও জুতা নিক্ষেপ করে উপস্থিত
জনতা। অবশ্য আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর
তৎপরতায় কোনো অঘটন ঘটেনি।
রায় ঘোষণার পর প্রধান আসামি শরীফের
মা ও আসামি বিউটি বেগম কান্নায় ভেঙে
পড়েন। তিনি বলেন, 'আমাদের পক্ষে কথা
বলার কেউ নাই। রাকিবের পরিবারের সঙ্গে
আমাদের কোনো শত্রুতা ছিল না। ওরা ওকে
মারতে চায়নি। মারতে চাইলে ওরা দুই ব্যাগ
রক্ত দিত না। হাসপাতালে নিয়ে যাইত না।
ইয়ার্কি মারতে গিয়ে ঘটনা ঘটছে।' কিন্তু
এই বিউটি বেগমের খালাস কোনোভাবেই
মানতে পারছে না রাকিবের পরিবারের
সদস্য ও স্বজনরা। মা লাকী বেগম রায়ের পর
বারবার মূর্ছা গেছেন। তিনি বলেন, 'বিউটি
বেগমের জন্যই আমার রাকিবের জীবন
গ্যাছে। ওর ফাঁসি চাই।' রাকিবের বাবা
আলম হাওলাদার বলেন, 'এ রায় মানি না।
বিউটি বেগমও দোষী। ওর বিচার চাই।'
রাকিবের খালা নাসরিন আক্তার (৩০)
বলেন, 'রাকিব আমাদের সন্তান ছিল না; সে
ছিল আমাদের বাবার মতো। ওই বাচ্চা বয়সে
রাকিব আমাদের আয় কইরে খাইয়েছে।'
রাকিবের ছোট বোন রিমি আক্তার বলে,
'আমার ভাইয়া খুব ভালো ছিল। সে কাজ
করতে যাওয়ার আগে আমাকে পড়তে বলত।
স্কুলে যেতে বলত। সে বলত আমাকে অনেক
লেখাপড়া শেখাবে।'
গতকাল সকালে খুলনা জেলা কারাগার
থেকে আসামিদের আদালতের হাজতখানায়
এনে রাখা হয়। সেখান থেকে কড়া পুলিশ
প্রহরায় সকাল ১১-৫০ মিনিটে তাদের
আদালতে নেওয়া হয়। এ সময়ে উপস্থিত
এলাকাবাসী তাদের ফাঁসির দাবিতে
আদালত চত্বরে স্লোগান দিতে থাকে।
শেয়ার করুন