আলোচনায় ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’: ইতিহাসের পাতা খুলছে নোয়াখালী দাঙ্গা ও ক্যালকাটা কিলিং
ভারতে প্রকাশ পেয়েছে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নামে সিনেমার ট্রেলার। তবে সম্প্রতি কলকাতায় এই ট্রেলার প্রকাশে বাধা দেওয়ার পর বিতর্ক শুরু হয়েছে। সিনেমাটির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে একাধিক এফআইআর হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, চলচ্চিত্রটিতে সাম্প্রদায়িকতার প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সিনেমাটির পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীদের বক্তব্যে সিনেমাটি নিয়ে তিনটি প্রসঙ্গ সামনে এসেছে। সেগুলো হলো ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’, ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ ও ‘নোয়াখালী দাঙ্গা’। তারা বলছেন, এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটেই সিনেমার কাহিনি রচিত হয়েছে।
গত বুধবার জি নিউজ সিনেমাটির অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর বক্তব্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে মিঠুন বলেন, ‘…আপনারা কি জানেন নোয়াখালীতে কী হয়েছিল? এটা আমার জন্মের আগে হয়েছিল। যা জানা যায় তা হলো অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ব্যস, এটুকুই। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ছিল। কীভাবে এবং কেন এটি হয়েছিল তা কেউ জানতে চায় না। কিন্তু বিবেক অগ্নিহোত্রী এটি বলছেন।’
বিবেক অগ্নিহোত্রী ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ সিনেমার পরিচালক। আগামী ৫ আগস্ট সিনেমাটি মুক্তির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমালোচনা শুরু হওয়ায় ১৮ আগস্ট সিনেমাটি নিয়ে দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলন করেন বিবেক। সেখানে সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, এই চলচ্চিত্র রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করে ইতিহাস বিকৃত করছে কি না। জবাবে বিবেক বলেন, এ বিষয়ে গবেষণায় তিনি দুই বছর সময় ব্যয় করেছেন। এবং যা উপস্থাপন করছেন, সেটিকে তিনি বাংলার ইতিহাসের অজানা গল্প বলে মনে করেন। সেদিন বিবেকও তাঁর বক্তব্যে সিনেমাটির কাহিনির প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’, ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ ও ‘নোয়াখালী দাঙ্গা’ উল্লেখ করেন।
এই ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’, ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ ও ‘নোয়াখালী দাঙ্গা’ কোন প্রেক্ষাপটে হয়েছিল? এসব প্রশ্নের বর্ণনা পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের ট্রিনিটি কলেজের দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক জয়া চ্যাটার্জীর একটি বইয়ে। ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কমিউনালিজম অ্যান্ড পার্টিশন, ১৯৩২-১৯৪৭’ শিরোনামের বইটি বাংলায় প্রকাশ করা হয়েছে ‘বাঙলা ভাগ হল’ নামে। ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ও ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বুঝতে এ সম্পর্কিত বর্ণনা বইটি থেকে তুলে ধরা হলো।
‘বাঙলা ভাগের প্রাদেশিক উৎস, ১৯৪৫-৪৬’ অংশে (পৃষ্ঠা-২৬৮) লেখা হয়েছে, ‘নির্বাচন মুসলিম লীগকে পুনরায় বাঙলায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকার গঠন করেন এবং তিনি বাঙলার নতুন প্রধানমন্ত্রী হন। এর ফলে হিন্দু বাঙালিদের প্রত্যাশা হতাশায় পরিণত হয়। কারণ দুর্ভিক্ষের সময় সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দী তাঁর কথিত দুর্নীতির জন্য হিন্দু জনমতের দৃষ্টিতে ভয়ংকর লোক বলে চিহ্নিত হন।’
এখানে ভারতীয় দৈনিক ইন্ডিয়া টুডের বরাত দিয়ে বলে রাখা ভালো, ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষ থেকে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন মুসলিম লীগ পৃথক দেশের দাবিতে ১৬ আগস্ট ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র ডাক দেয়।
বাঙলা ভাগ হল বইয়ের পৃষ্ঠা-২৬৯-৭১ এ লেখা হয়েছে, ‘১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মকালে দিল্লিতে কেবিনেট মিশন ও ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনার সময় জল্পনা-কল্পনা উত্তেজনার তুঙ্গে ওঠে। তখন কলকাতা ও পশ্চিম বাঙলার প্রাণকেন্দ্রের হিন্দুরা প্রদেশ বিভাগের পরিকল্পনাকে অনুকূল বলে মনে করে এবং এভাবে পশ্চিম বাঙলাকে একটি নতুন হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা চিন্তা করে। মুসলমানদের স্থায়ী শাসনের অধীনে থাকার পরিবর্তে পশ্চিম বাঙলার হিন্দুদের কাছে এই সমাধান অনুকূল বলে বিবেচিত হয়েছিল।’
ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে উপলক্ষে একটি সরকারি বিবৃতি দিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী। বইয়ে বলা হয়েছে, ‘সেখানে তিনি কেন্দ্রের বাইরে বাঙলার পুরোপুরি স্বাধীনতা ঘোষণার হুমকি দেন। সোহরাওয়ার্দীর এ বিবৃতির প্রতিক্রিয়া জানায় দ্য হিন্দু সংবাদপত্র। তারা এটিকে ব্যাখ্যা করে সমগ্র বাঙলাকে তখনই পাকিস্তান বানাবার হুমকি হিসেবে। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’কে তাই কলকাতার হিন্দুরা অস্তিত্বের জন্য আসন্ন হুমকি হিসেবে গণ্য করে, আর সে জন্য তারা আমরণ লড়াই করতে প্রস্তুত ছিল।’ এই প্রেক্ষাপটে কলকাতা হত্যাযজ্ঞ (গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং) সংঘটিত হয়। এই দাঙ্গায় কমপক্ষে পাঁচ হাজার লোক নিহত হয়। হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার চারদিন পর স্টেটসম্যান পত্রিকা লিখে, ‘আট ফুট লম্বা লাঠি নিয়ে পঙ্গপালের মতো অসংখ্য লোক অন্যকে আঘাত করছিল ও খুন করছিল।’
বইয়ে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় (পৃষ্ঠা ২৭১) উল্লেখ করা হয়েছে, কলকাতা হত্যাযজ্ঞকে ওই প্রত্যক্ষদর্শী ‘দাঙ্গা’ হিসেবে দেখেননি। দেখেছেন গৃহযুদ্ধ হিসেবে। তিনি বলেছেন, উভয়পক্ষ থেকে এ দাঙ্গা ছিল সু-সংগঠিত। সোহরাওয়ার্দী নির্মমভাবে এ দাঙ্গা সংগঠিত করেন এটা দেখার জন্য যে, মুসলমানেরা কলকাতা অধিকারে রাখবে। হিন্দু পক্ষে এটা ছিল বাঙলা ভাগের জন্য লড়াইয়ের একটা অংশ বিশেষ। (নোট: এই বর্ণনায় মনে হতে পারে কলকাতার দাঙ্গার জন্য সোহরাওয়ার্দী এককভাবে দায়ী। বাস্তবে ইতিহাসের পাঠ এতটা খন্ডিত হয় না।)
বইয়ের ২৭১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে আকস্মিক ছিল না। এটা ছিল উদ্ভূত বিভিন্ন ঘটনার ফল যা দীর্ঘদিন থেকে সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছিল। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার পর দেখা যায়, উভয় পক্ষের হাজার হাজার লোক নৃশংসভাবে নিহত হয়েছে। হত্যা শুরু হওয়ার দশ দিন পর কলকাতা শহরের ফুটপাতে তিন হাজারের বেশি মৃতদেহ পড়ে থাকে। মৃতদেহ পোড়ানোর জন্য শহরে যে ব্যবস্থা ছিল মৃতদেহের সংখ্যা তার তুলনায় অনেক বেশি ছিল। ফলে মৃতদেহ সংগ্রহ ও তা গণকবরে স্তূপ করার জন্য সরকারকে ডোমদের জড়ো করতে হয়।
‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ এর বেশ কিছুদিন পর নোয়াখালীতে আরেকটি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। এ নিয়ে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে (২ অক্টোবর ২০১৯) লেখা হয়েছে, ‘দশই অক্টোবর (১৯৪৬) ছিল কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন। উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার মধ্যে হঠাৎ করেই একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে।’ বিবিসির বর্ণনা অনুযায়ী, ওই গুজবের জেরে কিছু সহিংসতা ঘটে। পরে এসব ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়লে নোয়াখালীর রায়পুর, রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, ছাগলনাইয়া এবং পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা জেলার চাঁদপুর, চৌদ্দগ্রাম, হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ এবং লাকসাম থানার বিশাল এলাকাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এতে বহু মানুষ প্রাণ হারান।
সিনেমা নিয়ে যা জানা গেল
দ্য বেঙ্গল ফাইলস এখনো মুক্তি পায়নি। তবে এর আগেই পরিচালকের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এনেছেন কেউ কেউ। বিবিসি নিউজ বাংলার গত বুধবারের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা হলে মমতা ব্যানার্জীর সরকার সিনেমাটি প্রদর্শনের অনুমতি দেবে না। যুক্তি হিসেবে তারা বলছে, সাম্প্রদায়িকতায় উসকানি দিয়ে এই সিনেমাটি পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পরিবেশ আবার বিষিয়ে তুলতে চাইছে।’
আর বিজেপি নেতাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ছবিটিকে সব রকমভাবে সমর্থন জানাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। যারা বলছে, এই ছবিটির মাধ্যমে দেশভাগের সময় বাংলার হিন্দুদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, যা এতদিন রূপালী পর্দায় কেউ বলার সাহসই দেখাতে পারেননি।’
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন