যুক্তরাষ্ট্রের কদর্য দিক বেরিয়ে এসেছে
বারাক ওবামা শেষমেশ কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের হঠাৎ ও সাহসী ঘোষণা না দিলে ২০১৪ সালের শেষ সপ্তাহে অবশিষ্ট দুনিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে অক্লান্তভাবে নির্দয় হতো। যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থায় গভীর গলদ, সমাজের ভেতরে অন্তঃসলিলা বর্ণবাদ ও দেশটির সরকারের নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়গুলো দুনিয়ার সামনে উন্মোচিত হয়ে গেছে।পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক এক ব্যক্তিকে বশে এনে—সে দম বন্ধ হয়ে আসছে এ কথা বলার পরও—তাঁকে হত্যা করার ঘটনা দুনিয়ার অনেক দেশেই ঘটতে পারত। কিন্তু নিউইয়র্ক সিটিতে এরিক গার্নারকে হত্যা, ফার্গুসনে মাইকেল ব্রাউন হত্যা, গত নভেম্বরে ক্লিভল্যান্ডে তামির রাইসকে হত্যা—এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, দেশটির বিভিন্ন শহরে বসবাসরত আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণেরা পুলিশের কাছে নিরাপদ নন। ঝুঁকির মাত্রা বেশ উচ্চ। সম্প্রতি এক বিশ্লেষণ অনুসারে, আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণদের পুলিশের গুলি খেয়ে মরার হার সাদা তরুণদের তুলনায় ২১ গুণ বেশি।এরপর সিনেট সিলেক্ট কমিটি অন ইনটেলিজেন্সের ৫২৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের বিষয়টি উঠে আসে। এতে নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে সিআইএর আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ কর্মসূচির বিস্তারিত ফিরিস্তি রয়েছে। কমিটির কথিত ‘এক্সিকিউটিভ সামারি’-তে দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের বড়কর্তাদের নির্দেশনায় বন্দীদের সঙ্গে কী ভয়ংকর আচরণ করেছেন!আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের একদল সাবেক কর্মকর্তা এই কর্মকাণ্ডের সমালোচনা না করে তার সাফাই গাইতে নেমে পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনিকে মার্কিন টেলিভিশন জিজ্ঞাসা করেছিল, ওই বন্দীদের মধ্যে ২৫ শতাংশই ছিল নির্দোষ, সে বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী। জবাবে চেনি বলেছিলেন:‘উদ্দেশ্য হাসিল হলে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমাদের লক্ষ্য ছিল নাইন-ইলেভেনের হামলাকারীদের ধরা। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অনুরূপ হামলা যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করা।’ সিআইএর কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘বর্ধিত জিজ্ঞাসাবাদ’ কর্মসূচি নিয়ে এখনো জোর গলায় কথা বলে যাচ্ছেন, ওবামা যেটা স্থগিত করেছিলেন। যদিও সিনেটের প্রতিবেদনের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, এই কৌশলে কোনো মূল্যবান গোপন তথ্য পাওয়া যায়নি।হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের’ অন্যান্য গল্প থেকে দেখা যায়, যেসব মানুষকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি ছিল না। অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার আগে তারা সেরূপ হয়নি। যে সপ্তাহে সিনেটের প্রতিবেদন বের হলো, সে সপ্তাহে আমি আনন্দ গোপালের নতুন বই নো গুড ম্যান অ্যামাং দ্য লিভিং পড়ছিলাম। সে বইয়ে সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের একজন সমর্থক, একজন তালেবান কমান্ডার, কাবুলে জন্ম নেওয়া ও তালেবান আমলে পর্দার মধ্যে জীবন কাটিয়ে দেওয়া এক গৃহবধূর ভাষ্যে আফগানিস্তানের বর্তমান বাস্তবতার গল্প উঠে এসেছে।আমরা বারবার সেই একই গল্পের পুনরাবৃত্তি দেখছি। স্থানীয় কোনো দালাল রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত কারণে মার্কিন-সমর্থিত সরকারকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। মার্কিন সেনারা হয়তো সে বিষয়ে কিছু জানেই না। আর তার সঙ্গীরা তালেবান হিসেবে সমালোচনা করছে, এই হচ্ছে তার পরিণতি। এই গল্পের পুনরাবৃত্তি আরও অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটেছে: যারা সেখানে থাকে ও আফগান ভাষায় কথা বলে এবং সেখানকার পৃষ্ঠপোষকতা ও ক্ষমতার খেলা বোঝে। এরূপ অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই বছরের পর বছর ধরে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে।মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি বেশ সুবিধাজনক অবস্থানেই আছি। সেখান থেকে আমি বলতে পারি, সাম্প্রতিক সময়ে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র ইতিবাচক দিক হচ্ছে কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। শেষমেশ যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ান ও লাতিন আমেরিকান দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে। এরা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায়ই চাপাচাপি করেছে, দেশটির অবস্থান পরিবর্তনের চাপ দিয়েছে। হ্যাঁ, এই উদ্যোগই ওবামার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে স্বীকৃত হবে। এর ব্যঞ্জনা আগামী দশকগুলোতেও প্রতিধ্বনিত হবে।তার পরও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন বিষয়বস্তু লক্ষ করা গেছে ভালো ও খারাপ উভয় ক্ষেত্রেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মার্কিন প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তারা অন্য প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।কংগ্রেস এই নির্যাতনের প্রতিবেদনে নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রমের দালিলিক প্রমাণ সংরক্ষণ এবং জনসমক্ষে তা প্রকাশও করেছে। সিনেটর ডায়ানা ফেইনস্টেইন দৃঢ়সংকল্প নিয়ে কাজ করে একটি ব্যাপার নিশ্চিত করেছেন। যাতে করে সিনেট ইনটেলিজেন্স কমিটি মার্কিন জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতির দালিলিক প্রমাণ সংরক্ষণ ও তা নিয়ে গবেষণা করা যায়। সিআইএর প্রবল বাধার মুখেও তাঁরা সেটা করেছে (এমনকি সিআইএ গোপনে কমিটির কম্পিউটারেও হানা দিয়েছে)।ফেইনস্টেইন বলেছেন, ‘অনেক মানুষই এ প্রতিবেদন দেখিয়ে বলবে, “দেখো, মার্কিনরা কী করেছে”। খারাপ কাজের সাফাই গাইতে ও আরও সহিংসতা উসকে দিতে তারা এটা ব্যবহার করবে। আমরা এটা থামাতে পারব না। কিন্তু ন্যায়ভিত্তিক সমাজের প্রতি প্রতিশ্রুতির কারণেই ইতিহাস আমাদের মূল্যায়ন করবে; যে সমাজ পরিচালিত হয় আইনের ভিত্তিতে। কুৎসিত সত্যের মুখোমুখি হয়ে আমরা বলতে পারি, “আর কখনোই না”—এ কারণেই ইতিহাস আমাদের মূল্যায়ন করবে।’একইভাবে গণমাধ্যম ও অনেক সুশীল গোষ্ঠীও শুধু ব্রাউন, গার্নার ও অন্যদের হত্যাকাণ্ডের দালিলিক প্রমাণ সংরক্ষণ ও তা জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি, এসব ক্ষেত্রে পুলিশ কেমন বর্ণবাদী আচরণ করেছে, তা-ও সংরক্ষণ করেছে তারা। আর ওবামা যখন কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের ঘোষণা দিলেন, তখন হোয়াইট হাউস গত আধা শতাব্দীর মার্কিন নীতিকে ‘ব্যর্থ অ্যাপ্রোচ’ আখ্যা দেয়। হোয়াইট হাউসের ভাষ্যে, এতে যুক্তরাষ্ট্র একঘরে হয়ে পড়ে। গোলার্ধের রাজনীতিতে তার প্রভাব সংকুচিত হয়। কিউবার ক্ষেত্রেই তার হাত-পা বাঁধা পড়ে যায়।মার্কিনরা অন্য কারও চেয়ে ভালো (খারাপও নয়) কিছু নয়। নীতিকথা বলার কোনো অধিকার আমাদের নেই, অন্যদের কাছ থেকে অনেক শেখারও আছে আমাদের। সৌভাগ্যবশত, আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মতো একটি অসাধারণ উপহার দিয়ে গেছেন, যেটা আমাদের সব সময় আত্মশুদ্ধির দিকে ঠেলে দেয়।ভুল শুদ্ধ করার ক্ষমতা কোনো দিনও ভুল করাকে জায়েজ করে না। আমরা উন্মোচন করতে পারি, সেটা কোনো উদ্যাপনের ব্যাপার নয়। আমাদের মার্কিনদের জানতে হবে, কীভাবে নিজেদের দিকে তাকাতে হয়। সরকারের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। আমাদের বহু কিছুরই জবাব দিতে হবে। কিন্তু আমরা এটা অন্তত জানি, আমরা সঠিক প্রশ্নটিই জিজ্ঞাসা করেছি।
শেয়ার করুন