ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যেমন হতে যাচ্ছে মার্কিন ‘অভিবাসন নীতি’
ছবিঃ এলএবাংলাটাইমস
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প তার নির্বাচনী ইশতেহার অনুসারে এবং ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে গ্রহণ করা অভিবাসন সংক্রান্ত তার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার চেষ্টা করবেন এই মেয়াদে। আগামী ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে প্রথমেই অবৈধ অভিবাসন বন্ধ এবং বৈধ অভিবাসন সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করবেন বলে অনুমান করা যাচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার ইশতেহার সাপেক্ষে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেসব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেসব বিবেচনায় তিনি যেসব অভিবাসন নীতি গ্রহণ করতে পারেন, সেগুলো হলো-
সীমান্তে কড়াকড়ি
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ২০১৯ সালে আরোপ করা ‘রিমেইন ইন মেক্সিকো’ প্রোগ্রামটি পুনরুদ্ধার করবেন। এই প্রোগ্রাম অনুসারে, দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টাকারীদের এবং আশ্রয়প্রার্থীদের আইনি মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মেক্সিকোতে অপেক্ষা করতে হবে। এই প্রোগ্রামটি ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাতিল করে দিয়েছিলেন।
বাইডেন ২০২০ সালে ট্রাম্পকে পরাজিত করেছিলেন আরও মানবিক ও সুশৃঙ্খল অভিবাসন নীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে। তবে অবৈধভাবে মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্ত অতিক্রম করে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসীদের মোকাবেলায় বাইডেনের বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিলো। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাই অভিবাসন নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল।
এডিসন রিসার্চের এক্সিট পোলে দেখা গেছে, ৩৯ শতাংশ ভোটার বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী বেশিরভাগ অভিবাসীকে বহিষ্কার করা উচিত এবং ৫৬ শতাংশ ভোটার বলেছেন তাদের আইনি লড়াই এর জন্য আবেদন করার সুযোগ দেওয়া উচিত।
টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, তিনি কোভিড-১৯ এর সময়ে আরোপিত ‘টাইটেল ৪২’ নীতিও পুনর্বহাল করবেন। মার্কিন সীমান্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আশ্রয় চাওয়ার সুযোগ ছাড়াই অভিবাসীদের দ্রুত মেক্সিকোতে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া হচ্ছে এই টাইটেল ৪২।
ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের মন্তব্যের বরাত দিয়ে টাইম ম্যাগাজিন জানিয়েছে, জরুরি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ট্রাম্প সীমান্ত পারাপার, ফেন্টানিল ও শিশু পাচার বন্ধ করবেন।
ট্রাম্প বলেছেন, অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করা বা অন্যান্য অভিবাসন আইন লঙ্ঘনকারী সকল অভিবাসীদের আটক করার চেষ্টা করবেন তিনি। চলতি মাসের শুরুর দিকে এক নির্বাচনী প্রচারণা অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, তিনি কংগ্রেসের কাছে আরও অতিরিক্ত ১০ হাজার বর্ডার পেট্রোল এজেন্ট নিয়োগের জন্য তহবিল আহ্বান করবেন।
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন এবং ২০২৪ সালে নির্বাচিত হলে সীমান্ত প্রাচীরের ফাঁকফোকর বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার প্রশাসন ১,৯৫৪ মাইল (৩,১৪৫ কিলোমিটার) সীমানা জুড়ে ৪৫০ মাইল (৭২৫ কিলোমিটার) দেয়াল তৈরি করেছিল। নির্বাচনী প্রচারণা অনুষ্ঠানে ট্রাম্প আরও বলেন, চীন ও অন্যান্য দেশ থেকে অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে আসা বন্ধ করতে তিনি শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।
গণ নির্বাসন
ট্রাম্প মার্কিন ইতিহাসের বৃহত্তম নির্বাসন প্রচেষ্টা শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অপরাধীদের উপর কড়া দৃষ্টি নিবদ্ধ করে লক্ষ লক্ষ লোককে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য নিয়েছেন। তবে এই প্রচেষ্টা দেশের অভ্যন্তরীন সংস্থাগুলোর বাধার মুখোমুখি হতে পারে। গত সেপ্টেম্বরে উইসকনসিনে এক সমাবেশে ট্রাম্প বলেন, অভিবাসীদের বহিষ্কার করা হবে বেশ কষ্টসাধ্য ও ‘রক্তাক্ত গল্প'।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি, জার্মান ও ইতালীয় বংশোদ্ভূতদের অন্তরীণ করার জন্য সর্বশেষ ব্যবহৃত ২২৬ বছরের পুরনো আইন 'এলিয়েন এনিমিস অ্যাক্ট' ব্যবহার করে অপরাধমূলক রেকর্ড এবং সন্দেহভাজন গ্যাং সদস্যদের বহিষ্কারের জন্য নতুন আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন ট্রাম্প। অক্টোবরে কলোরাডোর অরোরায় এক সমাবেশে ট্রাম্প অভিবাসীদের মৃত্যুদণ্ডের আহ্বান জানান।
ট্রাম্পের ২০২৪ সালের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স অক্টোবরে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রতি বছর ১০ লাখ অভিবাসীকে বহিষ্কার করা ‘যুক্তিসঙ্গত' হবে। ২০২৩ সালের ফেডারেল অর্থবছরে জো বাইডেন একক বছর সাপেক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া নির্বাসনের মোট সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছেন - মোট ৪ লাখ ৬৮,০০০ অভিবাসীকে তাদের দেশে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে বা মার্কিন অভিবাসন কর্তৃপক্ষ অভিবাসীদের মেক্সিকোতে ফেরত পাঠিয়েছে।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নির্দিষ্ট কিছু দেশের উপর বা নির্দিষ্ট মতাদর্শের নাগরিকদের উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবেন। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা এমন একটি নীতি বহাল করা হলেও এবারে এর ব্যপ্তি আরও বাড়বে। ট্রাম্প ২০২৩ সালের অক্টোবরের ভাষণে গাজা, লিবিয়া, সোমালিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং ‘দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ অন্য যে কোনও দেশের’ নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ সীমাবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়া বিশ্বের আরও কিছু দেশের উপর নতুন করে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে- এমন সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছেন। ভাষণে ট্রাম্প গাজার সংঘাতের ওপর আলোকপাত করে বলেন, ইসলামপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী হামাসকে সমর্থনকারী অভিবাসীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করবেন। গত জুনে ট্রাম্প বলেছিলেন, একই সাথে তিনি কমিউনিস্ট, মার্কসবাদী ও সমাজতন্ত্রীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা দেবেন।
বৈধ অভিবাসন
ট্রাম্প গত বছর বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসরত অভিবাসীদের জন্মগ্রহণকারী শিশুদের জন্য ‘স্বয়ংক্রিয় নাগরিকত্ব’ বন্ধ করার চেষ্টা করবেন।
যদিও এই ধরনের পদক্ষেপ মার্কিন সংবিধান সংশোধনীর বিরুদ্ধে চলে যায় এবং সম্ভবত এই পদক্ষেপ ‘আইনি চ্যালেঞ্জের’ সূত্রপাত করবে। প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদিত শরণার্থীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমিয়ে এনেছিলেন এবং বাইডেনের শরণার্থী সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে ট্রাম্প বলেন, নির্বাচিত হলে তিনি আবারও পুনর্বাসন কর্মসূচি স্থগিত করবেন।
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি মেধাভিত্তিক অভিবাসন ব্যবস্থার ওপর জোর দেবেন যা আমেরিকার শ্রম বাজারকে সুরক্ষা দেবে এবং আমেরিকান মূল্যবোধকে উৎসাহিত করবে। কোভিড মহামারী চলাকালীন প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প অনেক কাজের ভিসা স্থগিতসহ কিছু ভিসা প্রোগ্রাম কঠোর করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
এছাড়া অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অভিবাসীদের মধ্যে যারা আমেরিকান নাগরিককে বিয়ে করেছেন এবং কমপক্ষে এক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন তাদের নাগরিকত্ব প্রদানে বাইডেনের কর্মসূচিরও সমালোচনা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প জুন মাসে একটি পডকাস্টে বলেছিলেন, মার্কিন কলেজ বা জুনিয়র কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করা বিদেশী শিক্ষার্থীদের গ্রিন কার্ড দেওয়ার পক্ষে তার সমর্থন রয়েছে। তবে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট পরে বলেন, ‘কেবলমাত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষিত কলেজ স্নাতকদের ক্ষেত্রে এই গ্রীন কার্ড নীতি প্রযোজ্য হবে, যারা স্থানীয় আমেরিকানদের বেতন বা কর্মী সংখ্যা হ্রাস করবে না’।
এছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্প জো বাইডেনের 'প্যারোল' কর্মসূচির অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মূলত প্যারোল প্রোগ্রামের মাধ্যমে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকদের সাথে কয়েক হাজার অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারছে এবং ইউক্রেনীয় ও আফগানীরা ওয়ার্ক পারমিটের অনুমতি পাচ্ছে। তিনি বাইডেনের এই কর্মসূচিকে 'প্যারোল কর্তৃত্বের জঘন্য অপব্যবহার' বলে অভিহিত করেছেন।
পারিবারিক বিচ্ছেদ
গত বছর সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প তার বিতর্কিত ‘জিরো টলারেন্স' নীতি পুনরায় শুরু করার সম্ভাবনা আছে বলে মন্তব্য করেন। এই জিরো টলারেন্স নীতির মাধ্যমে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে হাজার হাজার অভিবাসী শিশুকয়ে তাদের বাবা-মা থেকে আলাদা করে ফেলে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে স্প্যানিশ ভাষার সংবাদ মাধ্যম ইউনিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ‘এটি লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসীদের আগমন বন্ধ করে দিয়েছে। পারিবারিক বিচ্ছেদ নীতি পুনর্বহালের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও দ্বিতীয় মেয়াদে প্রশাসনে এটি যোগ হতে পারে’।
বাইডেন প্রশাসন গত বছর এই নীতির মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলির সাথে একটি সমঝোতা চুক্তিতে পৌঁছেছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে তাদের অস্থায়ী আইনি মর্যাদা এবং অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি কমপক্ষে আট বছরের জন্য অনুরূপ বিচ্ছেদ নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো।
ডাকা
যেসব শিশু হিসাবে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে আসে, তাদের ‘ড্রিমার’ আখ্যা দেওয়া হয়। এসব শিশু অভিবাসীদের সার্বিক ত্রাণ এবং ওয়ার্ক পারমিট দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে ট্রাম্প এই প্রোগ্রামটি বাতিল করতে চেয়েছিল, তবে ২০২০ সালের জুনে সুপ্রিম কোর্ট এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, তারা ডেফার্ড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভালস বা ডাকা নামে পরিচিত এই কর্মসূচির আওতায় নতুন কোনো আবেদন গ্রহণ করবে না।
নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ডাকা’র অবসান ঘটানোর পরিকল্পনা করছেন।
এলএবাংলাটাইমস/ওএম
শেয়ার করুন