দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় বিক্রি হওয়া টিকিটে ৫ কোটি ডলারের জ্যাকপট
ঢাকার নাগরিক সেবা নিয়ন্ত্রণ করে মাস্তানেরা
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে পৌনে তিন কোটির বসবাস বস্তিতে। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় দুই হাজার ১০০টিরও বেশি বস্তি। আর রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই বাস করে বস্তিতে। নগরজীবনের পরিপূর্ণ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এসব বস্তিবাসী।আবার এই ঢাকায় গড়ে উঠেছে একটি স্থানীয় ‘গ্যাংলর্ডস বা মাস্তান’ শ্রেণি। নাগরিক সেবা মূলত নিয়ন্ত্রণ করে এরাই। রাজধানীর বস্তিবাসী ও গরিব মানুষ, যাদের বিনা মূল্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়ার কথা, সেই সেবাই মাস্তানেরা বিক্রি করছে চড়া মূল্যে। গরিব মানুষগুলোকে বাধ্য হয়ে মাস্তানদের কাছ থেকেই সেবা কিনতে হচ্ছে। পাকিস্তানভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মাহবুব উল হক সেন্টার গতকাল সোমবার ‘দক্ষিণ এশিয়ার মানব উন্নয়ন: নগরায়ণের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক যে প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে, তাতে এ চিত্র উঠে এসেছে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সেবাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় গড়ে ওঠা মাস্তান শ্রেণিটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবেও বেশ শক্তিশালী। এ কারণে বস্তিবাসী ও গরিবদের মাঝে সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলোকে মাস্তানদের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখতে হয়। ঢাকার মতো একই চিত্র ভারতের বলিউড নগরখ্যাত মুম্বাই শহরেও।চারটি বস্তির ওপর পরিচালিত এক জরিপের ফলাফল উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সামাজিক বিভিন্ন অপরাধ ও হিংস্রতার ক্ষেত্রেও মাস্তানেরা বড় ভূমিকা পালন করে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯৩ শতাংশই বলেছেন, বছরজুড়েই প্রায় ৩৩ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও সহিংসতার শিকার হন তাঁরা। টোল আদায় থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা, জমি দখল, জুয়া খেলা, নারী ও শিশু নির্যাতন, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, অগ্নিসংযোগ, খুন, অপহরণসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত এসব মাস্তান।এ ছাড়া প্রতিবেদনে মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহরের তুলনামূলক নানা চিত্র উঠে এসেছে। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানও বলেছেন, ‘আমাদের নগরগুলো অপরিকল্পিত, অপরিচ্ছন্ন ও অনিয়মে পূর্ণ।’ এর জন্য কেন্দ্রমুখিতা ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আমাদের শহরবাসী দরিদ্ররা নগরের উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখলেও তাঁদের জীবনযাপনে ন্যূনতম সুবিধাও নিশ্চিত করা যায়নি।’প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বস্তিপ্রধান শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ভারতের মুম্বাই। মুম্বাই শহরটিকে ঘিরে আছে তিন হাজার বস্তি। যেখানে বাস করেন শহরটির সত্তর লাখ মানুষ, যা ওই শহরের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ। মুম্বাইয়ের চেয়ে যেন কোনো অংশে পিছিয়ে নেই বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের রাজধানী দিল্লিও। শহরটির প্রতি দুজন নাগরিকের মধ্যে একজনের বাস বস্তিতে।প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মোট জনসংখ্যার ১০ কোটি ৪৬ লাখের বেশি মানুষের বসবাস ওই দেশটিজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৫২ হাজারের বেশি বস্তিতে। পাকিস্তানে এ সংখ্যা প্রায় তিন কোটি, নেপালে পৌনে ৩১ লাখ। আর বস্তিতে বসবাসকারী মানুষগুলো প্রতিনিয়ত পয়োনিষ্কাশন, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত।মাহবুব উল হক সেন্টার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানব উন্নয়ন সূচকের সার্বিক যে চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে যত লোক বসবাস করে, তার ২১ শতাংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এ হার ৩৫ শতাংশের বেশি। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আফগানিস্তান। ওই দেশটির বিভিন্ন শহরে বসবাসকারীদের ২৯ শতাংশই রয়েছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে এ হার যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৭, ১৩ দশমিক ১, ৫ দশমিক ৩ এবং ১৫ দশমিক ৫।১৯৭০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পাঁচটি বড় শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলে ধরে ২০২৫ সালে এসব শহরের সম্ভাব্য জনসংখ্যার একটি হিসাব করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৫ সালে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে দুই কোটি ২৯ লাখে। একই সময়ে ভারতের দিল্লি, মুম্বাই ও কলকাতা শহরের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে তিন কোটি ২৯, দুই কোটি ৬৬ ও এক কোটি ৮৭ লাখে। এ সময় পাকিস্তানের করাচির জনসংখ্যা বেড়ে হবে দুই কোটি দুই লাখ। এর ফলে দুই কোটির বেশি জনসংখ্যা আছে, বিশ্বের এমন ১০টি শহরের মধ্যে চারটি শহর হবে দিল্লি, মুম্বাই, ঢাকা ও করাচি। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালের অবকাঠামো সুবিধা সবচেয়ে খারাপ। এ জন্য দেশগুলোর সরকারের প্রতিশ্রুতির অভাবকে দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) মাত্র সাড়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করে। অথচ ভিয়েতনাম প্রতিবছর এ খাতে ওই দেশের জিডিপির ৮ থেকে ১০ শতাংশ বিনিয়োগ করে থাকে। আর চীনে বিনিয়োগের এ হার মোট জিডিপির ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এ কারণে বিশ্বের বড় শহরগুলোর চেয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বড় শহরগুলো।রাজধানী ঢাকাকে বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী শহরগুলোর মধ্যে একটি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ শহরের প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৪ হাজারেরও বেশি লোক বসবাস করে। কিন্তু তাদের যাতায়াতের জন্য যে পরিবহনব্যবস্থা রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এমনকি এ শহরের ৫০ লাখেরও বেশি লোকের গণশৌচাগার ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। ঢাকার বস্তিগুলোতে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। তবে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঢাকা এগিয়ে রয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।আলোচনা: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) গতকাল বাংলাদেশে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘শহরগুলোকে শুধু টাকা তৈরির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা এমন শহর তৈরি করেছি যেখানে নিম্নবিত্তরা প্রান্তিক জীবন যাপন করছে, এমনকি মধ্যবিত্তরাও এখানে নাগরিক সম্মান পাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘অতিকেন্দ্রিকতা, অপরাধপ্রবণ স্থানীয় প্রশাসনের ফলে আমাদের নগরগুলোর উন্নয়ন হচ্ছে না। সরকার একা এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে না।’ এর জন্য নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির ওপরও জোর দেন তিনি।অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এ টি এম নুরুল আমিন বলেন, নিম্নআয়ের মানুষ নগরের জন্য অসুবিধা নয়, শক্তি। তাঁদের বাসস্থানসহ মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পরিকল্পনা করতে হবে।এর আগে অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, ‘আমাদের নগরগুলো ধনীবান্ধব। সব পরিকল্পনা তাঁদেরকে ঘিরেই। অথচ সাধারণ মানুষের জন্য ভূমি, খাদ্য এমনকি মৌলিক চাহিদাগুলোও নিশ্চিত করা যায়নি।’অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক সুলতান হাফিজ রহমান।
শেয়ার করুন