রেমিট্যান্স কমার কারণ উদঘাটনে কমিটি গঠন
সদ্য বিদায়ী বছরে (২০১৬ সাল) বাংলাদেশ থেকে গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ জনশক্তি রফতানি হয়েছে। এ সময় ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন কর্মী চাকরি নিয়ে বৈধ পথে বিদেশ গেছেন। ২০০৮ সালের পর এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। অথচ গত বছর পুরো সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে আগের বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ কম রেমিট্যান্স এসেছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে রেমিট্যান্স কমায় সরকারের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এজন্য রেমিট্যান্স কমার কারণ ও তা সমাধানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান ও প্রবাসীকল্যাণ সচিব বেগম শামছুন নাহারকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, রেমিট্যান্স কমার বিষয়ে তারা কয়েকটি বিষয় প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো- তেলের দাম কমে যাওয়া, ইউরো এবং পাউন্ডের বিনিময় মূল্য পড়ে যাওয়া এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ। এগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট কারণ জানতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করছেন। ওই কমিটি সুর্নিদিষ্ট কারণ নির্ধারণ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কমিটি কারণ নির্ধারণ করে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করলে সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। রেমিট্যান্সের এই অংক এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে আসা রেমিট্যান্সের তুলনায় ১৭০ কোটি ১৩ লাখ ডলার বা ১১ দশমিক ১১ শতাংশ কম। অথচ ২০১৫ সালের পুরো সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৫৩১ কোটি ২১ লাখ ডলার, যা ২০১৪ সালে আসা রেমিট্যান্স থেকে ৩৬ কোটি ৯৫ লাখ ডলার বা দুই দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। এর আগে প্রায় এক যুগ পর ২০১৩ সালে রেমিট্যান্স কমে গিয়েছিল। ওই বছর ৩৪ কোটি ডলার বা দুই দশমিক ৩৯ শতাংশ রেমিট্যান্স কম এসেছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে আনতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু উদ্যোগ কাজে আসছে না। প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ। বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমে যাওয়ায় প্রবাসীদের উপার্জন কম হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের নানা সঙ্কটে ইউরো ও পাউন্ডের দাম পড়ে যাওয়ায় প্রবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এসব কারণে একটু বাড়তি লাভের জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাচ্ছেন তারা। ফলে তা হিসাবে আসছে না।
ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, প্রবাসীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনটি বড় কারণে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। সেগুলো হলো- তেলের দাম কমে যাওয়া, ইউরো এবং পাউন্ডের বিনিময় মূল্য পড়ে যাওয়া এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ। এ কাজটা ব্যাংকিং আওয়ারের বাইরেও করা যায়। আর বিনিময় মূল্যও ব্যাংকের চেয়ে বেশি হওয়ায় বাড়তি কিছু টাকা পাচ্ছেন। যেমন ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠালে ডলারের বিপরীতে ৭৭ টাকা পাওয়া যায়। অন্যদিকে হুন্ডিতে পাঠালে মিলছে ৮৫ টাকা পর্যন্ত। এজন্যই তারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন। বিশেষ করে অল্প পরিমাণের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমেই পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। এতে ওই প্রবাসী লাভবান হলেও তা কোনো দেশের হিসাবে না আসায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে টাকার বিপরীতে পাউন্ড, ইউরো, রিয়ালের দর কমে গেছে। এ কারণে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে টাকা পাচ্ছেন কম। যে জন্য তারা এখন রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন। দর বাড়লে পাঠাবেন। সম্প্রতি হুন্ডির প্রবণতা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেসব রেমিট্যান্স আসছে সেগুলোর বেশিরভাগই হচ্ছে হুন্ডি। এ ছাড়া হুন্ডি, মুদ্রাপাচার ও নগদ আকারে কিছু রেমিট্যান্স আসছে।
মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোয় বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এজন্য কাজের ক্ষেত্র যেমন সংকুচিত হয়েছে, তেমনি বেতন-ভাতার পরিমাণও কমে গেছে। ফলে প্রবাসীদের আয়ও কমে গেছে। এসব কারণেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি যাওয়ার কারণে প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানোয় আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক নয়।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, হুন্ডির কারণেই মূলত রেমিট্যান্স কমছে। আর ব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য অনেক বেশি হওয়ায় হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন প্রবাসীরা। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
এলএবাংলাটাইমস/এন/এলআরটি
শেয়ার করুন