ফিদেল কাস্ত্রো আর নেই : মহানায়কের বিপ্লবী জীবন
কিউবার প্রাক্তন নেতা ফিদেল কাস্ত্রো মারা গেছেন।
স্থানীয় সময় শুক্রবার রাত ১০টা ২৯ মিনিটে ৯০ বছর বয়সে তিনি মারা যান বলে কিউবার রাষ্ট্রীয় টিভির এক ঘোষণায় বলা হয়েছে।
বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো প্রায় ৫০ বছর এক দলীয় রাষ্ট্র বা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে কিউবা শাসন করেন। এরপর ২০০৮ সালে ভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।
মহানায়কের বিপ্লবী জীবন
মহানায়কের মহাপ্রয়াণ হলো। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রাণপুরুষ ফিদেল কাস্ত্রো চলে গেলেন, রেখে গেলেন মানুষে মানুষে সাম্যের গৌরবাণ্বিত সংগ্রামের এক মহাইতিহাস।
বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিপরীতে ১৯৫৯ সালে সমাজতান্ত্রিক কিউবার গোড়াপত্তনের মধ্য দিয়ে মহানায়কের আসনে চলে আসেন ফিদেল কাস্ত্রো।
যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট কিউবার একনায়ক ফুলগেন্সিও বাতিস্তাকে সরিয়ে সমাজতান্ত্রিক শাসন কাঠামো গড়ে তোলেন ফিদেল কাস্ত্রো। স্নায়ুযুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের আগ্রাসী বিস্তারের বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে অটল রাখেন ইতিহাসের প্রবাদপুরুষ ফিদেল কাস্ত্রো।
কিউবায় মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কখনো মেনে নিতে পারেনি বিশ্বের শীর্ষ পরাশক্তির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কিউবাবিরোধী নানা অপতৎপরতায় জড়িত ছিল মার্কিন মুল্লুকের নেতারা। সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে টিকে ছিলেন কাস্ত্রো।
কিউবায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর থেকে অর্ধশতাব্দী কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন দেশটির বিরুদ্ধে বহু অপপ্রয়াস চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রগোষ্ঠী। তার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে ১০ জন প্রেসিডেন্ট তাকে হত্যা অথবা উৎখাতের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাস্ত্রোর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কাছে সেসব অপচেষ্টা ভণ্ডুল হয়েছে। দীর্ঘদিন কিউবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ৮১ বছরে ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন তিনি।
১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলে বিরান জেলায় স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক অভিবাসী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ফিদেল কাস্ত্রো। পুরো নাম ফিদেল আলেজান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ। তবে তিনি ফিদেল কাস্ত্রো বা শুধু কাস্ত্রো নামেই বেশি পরিচিত। কাস্ত্রোর বাবা ছিলেন আখের খামারের মালিক।
ছোটবেলা থেকে ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন ডানপিঠে। সব দিকেই ছিল তার প্রবল আকর্ষণ। জেসুইট বোর্ডিং স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন তিনি। ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার দারুণ আগ্রহ ছিল। ১৯৪৪ সালে কিউবার সেরা অলরাউন্ডার স্কুল অ্যাথলেট পুরস্কার পান তিনি। শিক্ষাজীবন শেষ করেন আইনে স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর।
আইনজীবী হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন কাস্ত্রো। দরিদ্র মক্কেলদের পক্ষে লড়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন। পেশাগত স্বীকৃতি ও সুখ্যাতি তাকে রাজনীতির মাঠে পরিচিত করাতে ভূমিকা রাখে।
রাজনৈতিক জীবন
মাত্র ১৩ বছর বয়সে নিজের বাবার আখের খামারে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করেন এবং একটি ধর্মঘটের ব্যবস্থা করেন।
১৯৪৭ সালে নবগঠিত কিউবান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন ফিদেল। মার্কিন ব্যবসায়ী শ্রেণি ও সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবিচার, দারিদ্র, বেকারত্ব ও নিম্ন মজুরির অভিযোগ নিয়ে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে তুখোড় বক্তা ফিদেল দলের তরুণ সদস্যদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
১৯৫২ সালে দলীয় কংগ্রেসের সদস্য প্রার্থী হন ফিদেল। নির্বাচনে পিপলস পার্টির বিজয়ের সম্ভাবনা থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে জেনারেল বাতিস্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করলে নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়।
বিপ্লবের মাধ্যমেই রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মাত্র ১২৩ জন নারীপুরুষের একটি সশস্ত্র দল নিয়ে ১৯৫৩ সালে মনকাডা আর্মি ব্যারাকে হামলা করেন ফিদেল। সংঘর্ষে আটজন নিহত হলেও ফিদেলের দল পরাস্ত হয় এবং তার প্রায় ৮০ জন সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয় বাতিস্তার নির্দেশে।
ফিদেলকে আটককারী লেফটেন্যান্ট `বিদ্রোহীদের আটক করামাত্র হত্যা করার নির্দেশ` উপেক্ষা করে তাকে বেসামরিক কারাগারে পাঠিয়ে দিলে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। কিন্তু কারাগারে তাকে বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। এবার দায়িত্ব ছিল ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারের ওপর। তিনি দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বরং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন। কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারকে। কিন্তু বিশ্ব জনমতের কথা বিবেচনা করে ফিদেলকে হত্যা না করে বিচারের মুখোমুখি করেন বাতিস্তা।
মনকাডা হামলায় অভিযুক্ত হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ফিদেল যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তা পরে `হিস্ট্রি উইল অ্যাবসল্ভ মি` বা `ইতিহাস আমার পাপমোচন করবে` নামে একটি বই আকারে বের হয়। ওই দীর্ঘ বক্তৃতার মধ্য দিয়ে কিউবার রাজনৈতিক সংকট এবং তার সমাধানের পথ নির্দেশ করেন তিনি। এতে রাতারাতি দেশব্যাপী বিখ্যাত হয়ে উঠেন এবং জননায়কে পরিণত হন ফিদেল। বিচারে তার ১৫ বছরের কারাদণ্ড হলেও প্রবল জনমতের কাছে মাথা নত করে দুই বছরের মাথায় তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন বাতিস্তা।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বিপ্লবী দল গড়ার লক্ষ্যে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান ফিদেল। সেখানে একটি গেরিলা দল গঠন এবং পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ের পর চে গুয়েভারা, জুয়ান আলমেইডা এবং অন্যান্যদের মিলিয়ে প্রায় ৮০ জনের একটি বিপ্লবী দল নিয়ে ১৯৫৬ সালে কিউবায় ফিরে আসেন ফিদেল।
গ্রানমা নামের একটি ছোট নৌকায় করে ফিদেলের বিপ্লবী দল কিউবায় এসে ভেড়ে। ফিদেলের ওই দলের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড `জুলাই টোয়েন্টিসিক্স মুভমেন্ট` নামে পরিচিতি লাভ করে। ফিদেল যেদিন মনকাডা ব্যারাকে হামলা করেছিলেন সেই তারিখ অনুসারে ওই নামকরণ করা হয়।
সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বতে নিজেদের ঘাঁটি গাড়ার লক্ষ্যে এগোনোর সময়ই বাতিস্তার সেনাদের আক্রমণের মুখে পড়েন তারা। সম্মুখ সমরে নিহত হয় বেশিরভাগ গেরিলা। মাত্র ১২টি অস্ত্র আর ১৬ জন গেরিলা নিয়ে শেষ পর্যন্ত নিরপদে ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হন ফিদেল।
স্থানীয় দরিদ্র জনগণের আশ্রয় নিয়ে ধীরে ধীরে দল বাড়াতে থাকে আর সেনা চৌকিগুলোতে চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করতে থাকে জুলাই টোয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট। বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ-যুবা-ছাত্র এ আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকে। অন্যদিকে গেরিলাদের ধরতে বাতিস্তার অভিযানে নিপীড়নের শিকার হয় অগণিত সাধারণ মানুষ এমনকি নারী ও শিশুরাও। এতে গেরিলাদের প্রতি জনসাধারণের সমর্থন আরও বাড়তে থাকে।
১৯৫৮ সালে এসে কিউবার মধ্যবিত্ত শ্রেণীরও সমর্থন লাভ করেন ফিদেল। ওই বছর আইনজীবী, চিকিৎসক, স্থপতি, হিসাবরক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার ৪৫টি পেশাজীবি সংগঠন যুক্তভাবে এক খোলা চিঠিতে জুলাই টোয়েন্টিসিক্স মুভমেন্টকে সমর্থন জানায়।
পেশাজীবীদের ওই খোলা চিঠির পর জেনারেল বাতিস্তা গেরিলা নিধন অভিযান আরও জোরদার করেন। এবারে ৩০০ বিশেষ সেনার নেতৃত্বে ১০,০০০ লোকের এক বিশাল বাহিনীকে পাঠানো হয় পার্বত্য অঞ্চলে। সংখ্যায় অনেক কম হলেও অসীম সাহসী গেরিলারা ধীরে ধীরে সম্মুখ সমরে জয়ী হতে থাকে এবং বহু সেনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। বাতিস্তার সেনাদের মতো হত্যা বা নির্যাতন না করে গেরিলারা বন্দি সেনাদের সঙ্গে মানবিক ব্যবহার করায় পলায়নপর সেনাদের মধ্যে আত্মসমর্পণের হার বাড়তে থাকে। অনেকে পক্ষ ত্যাগ করে গেরিলা দলে চলে আসে। এভাবে ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ সেনাদলের আকার নিতে শুরু করে জুলাই টোয়েন্টিসিক্স মুভমেন্টের গেরিলা দল।
ফিদেলের গেরিলারা এবার সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বত ছেড়ে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। স্থানীয় জনতা গেরিলাদের অভ্যর্থনা জানায়। ১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি বাতিস্তার প্রায় ১,০০০ সেনা গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারালে যুক্তরাষ্ট্র বিমান, বোমা, জাহাজ ও ট্যাংক পাঠিয়ে গেরিলাদের হঠানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু নাপাম বোমার মতো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও গেরিলাদের সঙ্গে বাতিস্তা পেরে না ওঠায় তাকে নির্বাচন দেওয়ার পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৫৮ সালের মার্চে বাতিস্তা নির্বাচন দিলেও জনগণ সে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। ৭৫ ভাগ থেকে শুরু করে কোথাও কোথাও ৯৮ ভাগ মানুষই ভোটকেন্দ্রেই যায়নি। ফিদেলের সেনারা চারদিক থেকে রাজধানী হাভানাকে ঘিরে ধরতে শুরু করলে ১৯৫৯ সালের পহেলা জানুয়ারি নববর্ষের দিনে কিউবা ছেড়ে পালান জেনারেল বাতিস্তা।
সেনাবাহিনীর অন্য সিনিয়র জেনারেলরা আরেকটি সামরিক সরকারের চেষ্টা চালালে ফিদেল দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন। কলকারখানা থেকে লাখ লাখ শ্রমিক আর সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসলে স্তব্ধ হয়ে যায় কিউবা। জনস্রোতের কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয় সেনাবাহিনী। ১৯৫৯ সালের ৯ জানুয়ারি রাজধানী হাভানায় ঢুকে দেশের নিয়ন্ত্রণভার নিয়ে নেয় ফিদেল কাস্ত্রোর গেরিলারা।
হাভানা জয়ের পরপরই কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফিদেল। ১৯৬৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অফ কিউবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং কিউবাকে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের কাজ শুরু করেন।
১৯৭৬ সালে কিউবার প্রেসিডেন্ট অব দ্য কাউন্সিল অব স্টেটস এবং কাউন্সিল অব দ্য মিনিস্টারস নির্বাচিত হন তিনি। একইসঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
দীর্ঘদিন কিউবার নেতৃত্ব দিয়ে ২০০৮ সালে ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ফিলেদ কাস্ত্রো। স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১০টা কিউবায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার মহাপ্রয়াণে বিশ্বনেতারা শোক জ্ঞাপন করেছেন। প্রাণপ্রিয় কিউবায় তার জন্য চলছে মাতম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।’
এলএবাংলাটাইমস/আই/এলআরটি
শেয়ার করুন